ভূমিকা: হোমিওপ্যাথির জনক স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের মতে, Homeopathy Psora Miasm হলো সেই অন্তর্নিহিত ‘উর্বর ক্ষেত্র’ বা ‘ভূমি’ (soil) অথবা এমন এক প্রবণতা, যা প্রায় সমস্ত রোগকে শরীরে বাসা বাঁধতে সাহায্য করে। শরীরের জীবনী শক্তিতে (Vital Force) এই মৌলিক ত্রুটি বা ফাটল না থাকলে, অন্য কোনো রোগ (তা তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী যাই হোক না কেন) তাত্ত্বিকভাবে শরীরে বিকাশ লাভ করতে পারত না। সোরা (Psora) কী? What do mean by Psora? Psora miasm in homeopathy নামকরণ: ‘Psora’ শব্দটি গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো ‘চুলকানি’ (Itch) মায়াজম (Miasm): হোমিওপ্যাথিতে সোরা হলো একটি মায়াজম। ‘মায়াজম’ হলো একটি বংশগত ত্রুটি বা দোষ, যা আপনাকে অসুস্থ হওয়ার প্রতি সংবেদনশীল করে তোলে। প্রকাশ: সোরা মূলত একটি ‘সংগ্রাম’ বা অস্থিরতার অবস্থা। এটি জ্বালা, চুলকানি, উদ্বেগ এবং এমন এক অনুভূতির দ্বারা চিহ্নিত হয় যেন—কোনো কিছুর অভাব আছে বা কিছু একটা ঠিক নেই। সোরা মায়াজমের সংজ্ঞা - Definition of Psora in Homeopathy মাস্টার কেন্টের মতে:- বিখ্যাত আমেরিকান হোমিওপ্যাথ জেমস টাইলার কেন্ট বিশ্বাস করতেন যে, Homeopathy Psora Miasm এর উৎপত্তি শরীরের আগে মানুষের মনে ঘটে। তিনি একে ‘ভ্রান্ত চিন্তা’ (thinking wrong) বা ঐশ্বরিক শৃঙ্খলা থেকে বিচ্যুতি হিসেবে দেখতেন। এটি স্বার্থপরতা এবং কামনার রূপে প্রকাশ পায়, যা শেষ পর্যন্ত শরীরকে অসুস্থতার দিকে ঠেলে দেয়। হ্যানিম্যানের হিসাব অনুযায়ী, Homeopathy Psora Miasm সমস্ত দীর্ঘস্থায়ী বা ক্রনিক রোগের ৮৭% এর মূল কারণ। যেখানে অন্য দুটি প্রধান মায়াজম, সিফিলিস (Syphilis) এবং সাইকোসিস (Sycosis), অবৈধ যৌন মিলনজনিত রোগের জন্য দায়ী, সেখানে সোরাকে যৌন-সংযোগহীন বেশিরভাগ দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণ হিসেবে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে: অটোইমিউন রোগসমূহ (Autoimmune disorders) অ্যালার্জি এবং হাঁপানি (Asthma) মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা (উদ্বেগ, বিষণ্নতা) কার্যগত ব্যাঘাত (হজমের সমস্যা, অনিদ্রা) ইতিহাস: সোরার মহাবিষ্কার - Invention of Homeopathy Psora Miasm হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান দীর্ঘ ঐতিহাসিক গবেষণার মাধ্যমে সোরার ধারণাটি আবিষ্কার করেন। সমস্যা: ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, হ্যানিম্যান লক্ষ্য করলেন যে জ্বর বা আঘাতের মতো ‘অ্যাকুিউট’ (acute) রোগগুলো তিনি সহজেই নিরাময় করতে পারছেন। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী বা ‘ক্রনিক’ রোগগুলো চিকিৎসার মাধ্যমে সাময়িক উপশম হলেও নির্দিষ্ট সময় পর আবার ফিরে আসছে। গবেষণা: এই ঘটনাটি তদন্ত করতে তিনি দীর্ঘ ১২ বছর ব্যয় করেন। তিনি তাঁর রোগীদের এবং হাজার বছরের পুরানো বিভিন্ন সভ্যতার চিকিৎসা ইতিহাস গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। উন্মোচন: ১৮২৮ সালে তাঁর যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘দ্য ক্রনিক ডিজিজেস’ (The Chronic Diseases)-এ তিনি ঘোষণা করেন যে, প্রায় সমস্ত দীর্ঘস্থায়ী রোগের একটি সাধারণ উৎস রয়েছে। আর তা হলো, চর্মরোগের অবদমন বা চাপা দেওয়ার ইতিহাস। তিনি সিদ্ধান্তে আসেন যে, শতাব্দী ধরে কুষ্ঠ, পাঁচড়া (scabies) এবং র্যাশের মতো চর্মরোগগুলোকে জোরপূর্বক চাপা দেওয়ার ফলে শরীরের অভ্যন্তরে ‘সোরা’ নামক এক দীর্ঘস্থায়ী রোগাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সেই অবস্থাকেই Homeopathy Psora Miasm হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সোরাকে কেন “রোগের জননী” (Mother of the Disease) বলা হয়? সোরাকে রোগের জননী বা মা বলার সুনির্দিষ্ট কারণগুলো নিচে আলোচনা করা হলো: ১. এটি রোগের “ক্ষেত্র বা উর্বর মাটি” (Soil)কল্পনা করুন আপনার শরীর একটি বাগান।এখানে সোরা হলো সেই বাগানের মাটি।আর ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস হলো বীজ।যদি মাটি (শরীর) সুস্থ থাকে, তবে আগাছা বা খারাপ বীজ সেখানে জন্মাতে পারে না। কিন্তু সোরা ‘অস্বাস্থ্যকর মাটি’ হিসেবে কাজ করে। এটি শরীরে এমন দুর্বলতা তৈরি করে যা জীবাণু, ভাইরাস এবং মানসিক চাপকে শরীরে গেড়ে বসতে সাহায্য করে। আপনি যদি সোরাকে দূর করতে পারেন, তবে রোগের বীজগুলো “কোথাও বেড়ে ওঠার জায়গা পাবে না।” ২. এটি প্রাচীনতম মায়াজম - Homeopathy Psora Miasmহোমিওপ্যাথি তিনটি প্রধান মায়াজমকে চিহ্নিত করে: সোরা (চুলকানি/প্রদাহ) সাইকোসিস (গনোরিয়া/অতিরিক্ত বৃদ্ধি) সিফিলিস (ধ্বংসাত্মক/ক্ষত) হ্যানিম্যান শিখিয়েছেন যে সোরা হলো প্রথম মায়াজম। অন্য মায়াজমগুলোর হাজার বছর আগে থেকেই এর অস্তিত্ব ছিল। সাইকোসিস এবং সিফিলিসকে ‘গৌণ’ বা পরবর্তী মায়াজম হিসেবে ধরা হয়। এরা কেবল এমন শরীরেই আক্রমণ করতে পারে যা আগেই সোরার কারণে দুর্বল হয়ে আছে। মূল ডিজিজ বা আদি রোগ মায়াজমের তিনটি দিক:- ক. উৎসের দিক (The Origin Aspect):সোরা হলো আমাদের অসুস্থ হওয়ার প্রাথমিক কারণ। মায়াজম মুক্ত একটি সম্পূর্ণ সুস্থ শরীর দুর্গের মতো কাজ করে, যেখানে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সহজে প্রবেশ করতে পারে না। সোরা সেই দুর্গের দেয়ালে ফাটল তৈরি করে। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে এতটাই দুর্বল করে দেয় যে সর্দি, ফ্লু বা অন্য কোনো দীর্ঘস্থায়ী রোগ শরীরে প্রবেশের সুযোগ পায়। সোরা ছাড়া সাইকোসিস বা সিফিলিসের অস্তিত্ব থাকা কঠিন, কারণ সোরা শরীরকে প্রস্তুত করে বলেই এরা প্রবেশ করতে পারে। খ. সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক (The Numerical Aspect):হ্যানিম্যানের মতে, মানুষের সব ধরনের দীর্ঘস্থায়ী কষ্টের ৮৭% কারণ হলো সোরা। হাঁপানি, অ্যালার্জি, উদ্বেগ, অনিদ্রা, বদহজম, মাইগ্রেন এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো অবস্থাগুলো মূলত সোরার কারণেই হয়। যেহেতু বেশিরভাগ অসুস্থতার জন্য এটিই দায়ী, তাই এটিই “জননী”। গ. কার্যগত দিক (The Functional Aspect):রোগ সাধারণত কয়েকটি ধাপে ঘটে। ধাপ ১ (সোরা): আপনি অসুস্থ বোধ করছেন। ব্যথা, জ্বালা বা ক্লান্তি আছে, কিন্তু এক্স-রে বা রিপোর্টে ডাক্তাররা কোনো সমস্যা খুঁজে পান না। এটি হলো কার্যগত বা ফাংশনাল ব্যাঘাত। ধাপ ২ (সাইকোসিস/সিফিলিস): যদি প্রথম ধাপকে উপেক্ষা করা হয়, তবে শরীর সিস্ট/টিউমার (বৃদ্ধি) বা আলসার/ক্ষত (ধ্বংস) তৈরি করে।মনে রাখতে হবে, শারীরিক ধ্বংস বা প্যাথলজির আগে সবসময় সোরার প্রথম ধাপটি উপস্থিত থাকে। সারসংক্ষেপ ছক (Summary Table): Homeopathy Psora Miasm পরিচয় ‘চুলকানি’ (Itch) মায়াজম; রোগের প্রথম এবং মৌলিক কারণ। উপমা (Analogy) সোরা হলো মাটি (Soil); রোগ হলো বীজ (Seed)। উৎস চর্মরোগের অবদমন বা চাপা দেওয়া এবং বংশগত সংক্রমণ। লক্ষণসমূহ চুলকানি, জ্বালাপোড়া, উদ্বেগ, কার্যগত ব্যাধি, অ্যালার্জি। কেন “জননী”? এটি শরীরের দরজা খুলে দেয়, যার ফলে অন্য সব রোগ প্রবেশ করতে পারে। উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, Homeopathy Psora Miasm কে সকল রোগের জননী বলা হয় কারণ এটি মানবদেহের গঠনের প্রাথমিক ত্রুটি। এটি স্বাস্থ্যের আড়ালে বহমান এক অদৃশ্য স্রোত, যা এমন এক অরক্ষিত অবস্থা বা দুর্বলতা তৈরি করে, যার সুযোগ নিয়ে অন্য যেকোনো রোগ শরীরে শেকড় গাড়তে পারে।